সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪: কেন ক্ষুব্ধ সকল শ্রেণির মানুষ?

প্রকাশ: রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪ রিপোর্ট
https://techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ এ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্পষ্ট, সহজ ও বোধগম্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অধ্যাদেশ বা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এজন্য আইনের খসড়া প্রণয়নের সময় নারী, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ আইন ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে রবিবার অনুষ্ঠিত “প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪” শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভায় এই দাবি জানানো হয়। যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি), সাইবার টিনস ফাউন্ডেশন এবং সেফটি নেট।

আলোচনা সভার শুরুতে ব্লাস্ট-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মনীষা বিশ্বাস প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ এবং বিগত সাইবার সম্পর্কিত আইনের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি আইনের মূল অস্পষ্টতা এবং উদ্বেগজনক বিষয়গুলো তুলে ধরে পদ্ধতিগত ফাঁকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তার উপস্থাপনায় বিশেষভাবে উঠে আসে যে অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা আইনের গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।

ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি)-এর প্রধান নির্বাহী পরিচালক সাঈদ আহমেদ পুরো মতবিনিময় সভাটি সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬-এর ৫৭ ধারাসহ অন্যান্য নিবর্তনমূলক ধারা, যা পরবর্তীতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তা এই নতুন অধ্যাদেশেও বিদ্যমান। অপরাধের অস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সীমাহীন ক্ষমতা এই আইনের অপব্যবহারের ঝুঁকি আগের মতোই বহাল রাখবে।

সভায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য সুমাইয়া ইসলাম বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, “নারী শ্রমিকরা প্রায়ই মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারের শিকার হন। দৃষ্টি ও বাক প্রতিবন্ধী নারীরা আদালতে বৈষম্যের সম্মুখীন হন। এই আইন নারী সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করবে।”

তিনি আরও বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল মেজবাহ বলেন, ‘‘সাইবার স্পেস সাধারণত তিনটি আইন দ্বারা পরিচালিত হয়: তথ্য প্রযুক্তি আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং উপাত্ত সুরক্ষা আইন। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশটি এই তিনটি আইনের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে, যা এর কাঠামো এবং কার্যকারিতায় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই আইনটির নাম সাইবার নিরাপত্তা আইন হওয়া উচিত, সাইবার সুরক্ষা আইন নয়। অধ্যাদেশে প্রযুক্তি আইনের তিনটি দিক একত্রিত করায় এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আইনটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কতটা উপযুক্ত, তা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। আইনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একজন প্রাকৃতিক ব্যক্তির সমতুল্য বিবেচনা করা হয়েছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।”

ধারা ৮-এর প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, “অধ্যাদেশে কন্টেন্ট ব্লক বা অপসারণের জন্য দুটি কর্তৃপক্ষের কথা বলা হয়েছে। তবে, কোন কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। একইভাবে, ধারা ২৫-এ ব্যবহৃত ‘মানহানিকর’ এবং ‘মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত’ শব্দগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং নির্দিষ্টকরণ প্রয়োজন।”

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, “সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। অধ্যাদেশে ডিজিটাল সাক্ষ্য এবং ডিভাইসকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়। তদুপরি, কোন অপরাধ সাইবার সুরক্ষা আইনে বিচার হবে এবং কোন অপরাধ পর্নোগ্রাফি আইনের আওতায় আসবে, তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি।’’

ব্লাস্ট-এর লিগ্যাল স্পেশালিস্ট এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট আয়শা আক্তার বলেন, ‘‘এই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় জনমতের প্রতি কোনোরকম তোয়াক্কা করা হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কাছ থেকে কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন থাকে, যা এই অধ্যাদেশেও প্রতিফলিত হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতি থেকে মুক্ত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এই আইন প্রণয়ন করা উচিত।’’

অগ্নি ফাউন্ডেশনের সভাপ্রধান এবং মেয়ে নেটওয়ার্কের সংগঠক তৃষিয়া নাশতারান বলেন, ‘‘যদিও সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধার অধিকারের কথা খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, তবে বিনা জবাবদিহিতায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা একটি স্পষ্ট পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি করে। এই অধ্যাদেশে নাগরিকদের প্রতি শাস্তিমূলক মনোভাব এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যা আইনটিকে আরও অবদমনমুখী করেছে।’’

প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের সদস্য শারমিন আকতার এই আইনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের কার্যকর অবস্থাতেও তারা কোনো সুবিধা পাননি; বরং বিভিন্ন প্রকার ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে। সাইবার প্রক্রিয়া এবং তথ্যের ব্যবহার সহজতর করার পাশাপাশি থানার সেবা প্রদানকারী অফিসারদের ইশারা ভাষার উপর প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার নিয়োগের মাধ্যমে সেবা আরও কার্যকর করা যেতে পারে। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, অনলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহজ প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা এবং সকল আইনে তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

দলিত নারী ফোরামের কমিউনিটি মবিলাইজার পূজা রানী দলিত জনগোষ্ঠীর উপর আইনের প্রভাব নিয়ে বলেন, ‘‘দলিত মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়ে আসছে। তবে, সঠিক তথ্যের অভাব এবং সেবা প্রদানের যথেষ্ট সুযোগ না থাকায় তারা আইনের আওতায় সঠিকভাবে সুরক্ষা পাচ্ছে না। তিনি সুপারিশ করেন যে প্রতিটি থানায় সাইবার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অফিসার নিয়োগ করা উচিত। এই অফিসার দলিতসহ সকল পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের অভিযোগ গ্রহণ করবেন এবং তাদের সেবা নিশ্চিত করবেন।’’

আদিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক ম্যা মো খাইং বলেন, ‘‘ধর্মীয় মূল্যবোধের অপব্যবহার এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আলাদা রাখার মাধ্যমে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ইন্টারনেট সেবা থেকে দূরে রাখা এবং তাদের উপর বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা আরোপ করার মাধ্যমে তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। নতুন অধ্যাদেশ বা আইন প্রণয়নের আগে জনমতের সমর্থন এবং জরিপ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, এই আইনটি যেন আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষিত রাখে, তা নিশ্চিত করা উচিত।’’

মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা একটি মিডিয়েশন ফোরাম গঠনের সুপারিশ করেন, যেখানে প্রশিক্ষিত সাইবার পুলিশ এবং জেন্ডার ডাইভার্স কমিউনিটি ও শিশুদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হবে। তারা ডিজিটাল লিটারেসি এবং ডিজিটাল সংবেদনশীলতার প্রসার ও প্রচারের ওপরও জোর দেন।

প্রসঙ্গত, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্ববর্তী বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল করে নাগরিকের মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য খসড়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ প্রণয়ন করেছেন। পূর্ববর্তী ডিজিটাল অধিকার বিষয়ক আইনগুলো নাগরিকদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও অনলাইনে নারী, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধ এবং বিচার সংক্রান্ত বিধানগুলো বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। বর্তমান খসড়া আইনটির বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা মূল্যায়ন এবং এটি নারী, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার-বান্ধব করার দাবি উত্থাপিত হলো।
image

আপনার মতামত দিন